ব্যাটারি রিকশা : নগর জীবনের অদৃশ্য মৃত্যুঘণ্টা : পুলিশ কমিশনার

প্রকাশিত September 27, 2025
ব্যাটারি রিকশা : নগর জীবনের অদৃশ্য মৃত্যুঘণ্টা : পুলিশ কমিশনার

সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী, পিপিএম এই লেখাটির মাধ্যমে নগরবাসীর নতুন যন্ত্রণাচিত্র তুলে ধরে যন্ত্রণা নিরসনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

ভূমিকা
সিলেট—একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত, প্রবাসী অধ্যুষিত, প্রকৃতিসমৃদ্ধ নগর। এই শহরের প্রাণশক্তি হলো নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন, কর্মচাঞ্চল্য ও নিরাপদ চলাচল। কিন্তু আজ সেই জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ফেলছে একটি নতুন অশুভ উপাদান—ব্যাটারি চালিত রিকশা।
একদিকে সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অগণিত পরিবার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, অন্যদিকে এটি আমাদের বিদ্যুৎ সংকট, যানজট ও পরিবেশ দূষণের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন হলো—আমরা কি আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে ব্যাটারি রিকশার বিষাক্ত চাকায় পিষে যেতে দেবো?

সড়ক দুর্ঘটনা : প্রাণ যাচ্ছে প্রতিদিন
বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা ফাউন্ডেশনের (২০২৪) তথ্যমতে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ব্যাটারি চালিত রিকশা।
চালকদের নেই প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্স। নেই সড়ক নিয়ম সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা। যানবাহনে নেই মানসম্মত ব্রেক, সিগন্যাল বা ফিটনেস।
ফলাফল—শিশু, বৃদ্ধ, শিক্ষার্থী, কর্মজীবী কেউই রক্ষা পাচ্ছে না। প্রতিটি দুর্ঘটনা মানে একটি পরিবারে শোক, একটি মায়ের বুক খালি হয়ে যাওয়া, একটি শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া।
‘‘একটি রিকশার বেপরোয়া চালনা মানে এক পুরো পরিবারের চোখের পানি।’’

অসহনীয় যানজট : নগরের গতি স্তব্ধ
সিলেটের রাস্তায় সংকট নতুন নয়। কিন্তু ৪০ হাজার ব্যাটারি রিকশা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
অফিসগামী মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকেন। স্কুলগামী শিশুরা সময়মতো পৌঁছতে পারে না। রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ায় দেরি হয়। অর্থনীতির উৎপাদনশীল সময় নষ্ট হয়।
বিশ্বব্যাংকের (২০২৩) গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় যানজটে প্রতিদিন ৩.২ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। সিলেটও সেই একই পথে হাঁটছে।

বিদ্যুৎ সংকট : অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘরবাড়ি
সিলেট মহানগরীতে যেখানে ৩ লাখ পরিবার বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, সেখানে ৪০ হাজার ব্যাটারি রিকশা প্রতিদিন ২ লাখ কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ খরচ করছে।
একটি ব্যাটারি রিকশা চার্জ দিতে লাগে গড়ে ৪–৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার পরিবার আলো জ্বালাতে পারত।
“আমাদের সন্তানেরা যখন পড়ার টেবিলে অন্ধকারে বসে থাকে, তখন সেই বিদ্যুৎ রিকশার চাকায় পুড়ে যাচ্ছে।”

বিষাক্ত সীসা: অদৃশ্য ঘাতক
প্রতিটি ব্যাটারির ভেতরে থাকে সীসা (Lead)—যা পৃথিবীর অন্যতম মারাত্মক বিষ।
WHO (২০২২) : সীসা মানুষের স্নায়ুতন্ত্র ধ্বংস করে। শিশুদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। গর্ভবতী নারীর গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। নষ্ট ব্যাটারি ডোবা-খালে ফেলে দিলে মাটি ও পানির মারাত্মক দূষণ হয় অর্থাৎ, আমাদের খাদ্য, মাটি ও পানি প্রতিদিন বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে।

মানসিক চাপ: অশান্ত নগরজীবন
ব্যাটারি রিকশা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
যানজটে দীর্ঘ সময় আটকে থেকে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে।
অগোছালো চলাচলে বিরক্তি বাড়ছে। সামাজিক অশান্তি তৈরি হচ্ছে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গবেষণা অনুযায়ী, দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকা মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশনের হার ৪০% বেশি।

গর্ভাবস্থা ও পরবর্তী প্রজন্ম
American College of Obstetricians and Gynecologists (২০২১) জানিয়েছে—সীসা রক্তের মাধ্যমে ভ্রূণের শরীরে প্রবেশ করে। জন্মগত ত্রুটি ও মৃত সন্তান জন্মের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
আমরা কি চাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জন্মের আগেই ধ্বংস হয়ে যাক?

আইনগত বাস্তবতা
সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ : অবৈধ যানবাহন চলতে পারে না।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন : সীসা দূষণ দণ্ডনীয় অপরাধ।
বিদ্যুৎ আইন : অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অতএব, ব্যাটারি রিকশা কেবল সামাজিক ক্ষতি নয়, আইনগতভাবেও অবৈধ।

সমাধানের পথ
সমাধানহীন কোনো সমস্যা নেই।
পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন চালু
সাইকেল ও পদচারী-বান্ধব উদ্যোগ
পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আধুনিকীকরণ।

মানবিক আবেদন
আজ আমি পুলিশ কমিশনার হিসেবে নয়, একজন বাবা, একজন নাগরিক হিসেবে আপনাদের কাছে আবেদন করছি—আপনার সন্তানকে ভালোবাসলে, ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে দাঁড়ান।
আপনার সাময়িক সুবিধা হয়তো কমবে, কিন্তু নগর বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে, প্রজন্ম বাঁচবে।

উপসংহার
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ ইতোমধ্যেই ব্যাটারি রিকশা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি কেবল প্রশাসনিক নয়, মানবিক সিদ্ধান্ত।
আমরা কোনোভাবেই চাই না, সিলেটের মানুষ ব্যাটারি রিকশার বিষাক্ত চাকায় পিষ্ট হোক।

এই আন্দোলন আমাদের সবার। আসুন শপথ করি—
ব্যাটারি রিকশা আর নয়
নিরাপদ সড়ক চাই
সুস্থ পরিবেশ চাই
আলোকিত প্রজন্ম চাই

সিলেট হোক শান্তির, সৌন্দর্যের, নিরাপত্তার নগর।